সম্পদের উৎপাদন, বণ্টন ও সমতার নীতি

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান - History & Social Science - NCTB BOOK

সম্পদের উৎপাদন, বণ্টন ও সমতার নীতি

এই শিখন অভিজ্ঞতায় আমরা নিজ এলাকার কয়েকটি অর্থনৈতিক সমস্যা চিহ্নিত করব। এরপর সমস্যাগুলোর মধ্যে কোনটি সামাজিক প্রেক্ষাপট নির্ভর এবং কোনটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্ভর তা নির্ণয় করব। এরপর পাঠ্যপুস্তকে প্রদত্ত অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত্ব অনুসারে এলাকার সমস্যা সমাধানের জন্য একটি প্রজেক্ট বেছে নিব। সেই প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কী কী সম্পদ প্রয়োজন এবং এই সম্পদ উৎপান, বণ্টন, ভোগ ও সংরক্ষণের উপায় নির্ধারণ করব। সেই সাথে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা নির্ধারণ করব। এরপর আমরা একটি মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে সেখানে আমাদের প্রজেক্ট উপস্থাপন করব। সবশেষে একটি রিপোর্ট তৈরি করে জমা দিব।

দলগত কাজ ১ আমরা ৫ থেকে ৬ জন একই এলাকার সহপাঠী মিলে একটি দল গঠন করি। এরপর আমরা দলে আলোচনা করে আমাদের এলাকার কিছু অর্থনৈতিক সমস্যা নির্ণয় করি। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে কোনটি সামাজিক প্রেক্ষাপট-নির্ভর এবং কোনটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট-নির্ভর তা নির্ধারণ করি।
সামাজিক প্রেক্ষাপট-নির্ভর সমস্যারাজনৈতিক প্রেক্ষাপট-নির্ভর সমস্যা

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এই সমস্যাগুলো আমরা অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান করার চেষ্টা করব। চলো, তাহলে আমরা এখন অর্থনীতির কিছু বিষয় সম্পর্কে জানি।

কিছু বিষয় জেনে নিই 

যখন কোনো দ্রব্য বা পণ্য উপযোগ বা ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়, তখন তাকে উৎপাদন বলা যায়। উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া পরস্পর সম্পৃক্ত। একটি উদাহরণ দিয়ে আমরা বুঝতে পারি। একজন কৃষক যখন চাল উৎপাদন করেন, তখন তিনি চাল বিক্রির জন্য সম্ভাব্য ভোক্তা নির্ধারণ করেন। ভোক্তা হচ্ছেন যিনি চাল ক্রয় করবেন। এরপর তিনি উৎপাদিত চাল নির্দিষ্ট মূল্যে বাজারে বিক্রি করেন। চাল বাজারে নিয়ে গিয়ে ভোক্তার (যিনি চাল কিনবেন) কাছে পৌঁছান। যাকে বণ্টন বলা যায়। সেই সঙ্গে চাল মজুদ রাখার জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। উৎপাদনের উপাদান বা উপকরণ: উৎপাদনের উপাদান বা উপকরণ চারটি।

১. মূলধন (Capital) 

২. ভূমি (Land) 

৩. শ্রম (Labour) 

৪. সংগঠন (Organization)।

উদাহরণ: একটা পাউরুটি উৎপাদন করতে কী কী উপকরণ ব্যবহার করা হয় তা যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে দেখব পাউরুটি উৎপাদন করার একটি কারখানা থাকতে হবে। এই কারখানাকে আমরা মূলধন (Capital) বলতে পারি। এরপর পাউরুটি তৈরির কাঁচামাল গম যা থেকে ময়দা পাওয়া যায়। এই গম প্রকৃতি থেকে বা ভূমি (Land) থেকে চাষাবাদের মাধ্যমে পাওয়া যায়। পাউরুটি তৈরি করতে শ্রমিকও প্রয়োজন। শ্রমিক থেকে আমরা শ্রম (Labour) পেয়ে থাকি। কোনো উৎপাদনের বেশির ভাগ শ্রম দ্বারা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সংগঠন (Organization)। পাউরুটি তৈরি করতে একজন উৎপাদক বা মালিক বা সংগঠক লাগে। তিনি উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ ভূমি, মূলধন এবং শ্রমকে কাজে লাগিয়ে পাউরুটি তৈরি করেন। যার উৎপাদনের উপকরণের পরিমাণ বেশি তার আয় বেশি।

আমরা টিভি চ্যানেলে অনেক সময় অর্থনীতিবিষয়ক সংবাদ দেখে থাকি। এ রকম দুটি সংবাদ সম্পর্কে আমরা জেনে নিই।

প্রিয় দর্শক, সংবাদে এখন থাকছে একজন সফল তরুণ উদ্যোক্তার সফলতার পেছনের কাহিনি। জাহাঙ্গীর আলম, তিনি একজন তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি যখন মাধ্যমিক শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী, তখন স্কুলের পাঠ্যবইতে পরিবেশ সংরক্ষণের উপায় নিয়ে কাজ করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন কীভাবে ব্যবহৃত প্লাস্টিককে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। তাই তখন সিদ্ধান্ত নেন ব্যবহৃত ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের জিনিস পুনরায় ব্যবহার করার একটি ব্যবসা দাঁড় করাবেন। তাই পড়াশোনা শেষে তিনি এই ব্যবসা শুরু করেন। সহপাঠী চার বন্ধু মিলে গড়ে তুললেন একটি সংগঠন। খুব কম মূলধনে মাঠে নেমে পড়লেন এবং মাত্র পাঁচ বছরে ভালো মুনাফা লাভ করলেন। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবসার মাধ্যমে তিনি নিজের আয় বৃদ্ধি ও সমাজের কল্যাণ দুইদিকেই অবদান রাখতে পারছেন।

সংবাদ শিরোনাম: বাংলাদেশের ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে মৃৎশিল্পের সম্ভাবনা

প্রিয় দর্শক, এবার বাংলাদেশের ক্ষুদ্র শিল্প-সম্পর্কিত কিছু তথ্য আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারে ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেখানে উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করার কথা বলেছেন। তারা জনসাধারণের মধ্যে এই মৃৎশিল্পকে জনপ্রিয় করার জন্য সরকার ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। সেইসঙ্গে সঠিক প্রচারণা করা হলে এই শিল্প বর্হিবিশ্বের ভোক্তাদের মধ্যেও ব্যাপক চাহিদা তৈরি করতে পারবে বলে উদ্যোক্তারা আশা ব্যক্ত করেন।

 

 

অনুশীলনী কাজ ১: উপরের দুটি সংবাদের মধ্যে আমরা কি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি? চলো, আমরা দলগতভাবে পার্থক্যগুলো খুঁজে বের করি।

 

এক তরুণ উদ্যোক্তার সফলতার কাহিনিবাংলাদেশের ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে মৃৎশিল্পের সম্ভাবনা

 

 

 

 

 

 

 

আমরা পার্থক্য লেখার সময় হয়তো ভেবেছি, একটি সংবাদে একজন তরুণ উদ্যোক্তার কথা বলা হয়েছে। তার সংগঠন, মূলধন ও মুনাফার কথা বলা হয়েছে। অপর সংবাদটিতে বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে

অর্থনীতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। যেমন: একজন উদ্যোক্তা বা ফার্মের মালিক কী উৎপাদন করবেন, কীভাবে উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেবেন, কতটুকু উৎপাদন করবেন, দাম কীভাবে নির্ধারিত হবে, উপকরণের জন্য কী পরিমাণ ব্যয় করবেন, কী কী উপকরণ ব্যবহার করবেন ইত্যাদি ছোটো ছোটো সিদ্ধান্ত ব্যষ্টিক অর্থনীতির আওতাভুক্ত। একজন ভোক্তার কোনো দ্রব্য বা সেবা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। তাই প্রথম সংবাদটিকে আমরা ব্যষ্টিক অর্থনীতির উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি।

অপরদিকে, জাতীয় অর্থনীতির বিষয়গুলো সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। মোট ভোগ, মোট সঞ্চয়, মোট বিনিয়োগ, মোট উৎপাদন, সাধারণ দামস্তর ইত্যাদি সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। তাই দ্বিতীয় সংবাদটি সামষ্টিক অর্থনীতির উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির আরো একটি উদাহরণ: ব্যষ্টিক অর্থনীতি বলতে কোনো একটি শিল্পের ছোটো/ক্ষুদ্র একটি ইউনিট বোঝায়। যেমন: অনেকগুলো পাটকল নিয়ে গড়ে ওঠে একটি পাট শিল্প। এই ধরনের একটি পাটকলের উৎপাদন-সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচনার বিষয়। যেমন: আমিন জুট মিলসের উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় এবং বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে আমরা ব্যষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব।

আবার যখন সকল পাটকল বা পাটশিল্প নিয়ে একত্রে বা সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব তখন তা সামষ্টিক অর্থনীতি হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন: বাংলাদেশের পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মজুরি, দাম এবং উৎপাদন এই বিষয়গুলো সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।

অর্থনৈতিক এজেন্টস (যেমন: ভোক্তা, উৎপাদক, ব্যক্তি, পরিবার, ফার্ম, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক)) এবং তাদের আচরণগত ধরনের ওপর ভিত্তি করে আমরা অর্থনীতিকে দুইভাগে ভাগ করতে পারি।

 

দলগত কাজ ২ 

এখন আমরা দলগতভাবে নিজ এলাকার অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর কোনটি ব্যষ্টিক ও কোনটি সামষ্টিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত তা নির্ণয় করি।

ব্যষ্টিক অর্থনীতি

সামষ্টিক অর্থনীতি

 

 

 

 

 

 

 

 

নিচের পত্রিকার রিপোর্টটি আমরা পড়ে নিই।

বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়েছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহণ মালিকেরা জনপ্রতি সিট ভাড়া বাড়িয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অন্যদিকে পরিবহণ মালিকদের দাবি জ্বালানি তেল ক্রয়, কর্মচারীর বেতন ও পরিবহণ মেরামত বাবদ এখন তাদের খরচ বেড়েছে আগের চেয়ে দ্বিগুণ। তাই তারা বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীভাড়া বাড়াতে। অন্যদিকে যাত্রীদের মতামত- জ্বালানি তেলের যে পরিমাণ দাম বেড়েছে সে অনুপাতে অনেক বেশি ভাড়া বাড়িয়েছে পরিবহণ মালিকেরা। এজন্য অর্থনীতিবিদগণ সরকারের যথাযথ নজরদারির গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

 

 

 

 

 

আমরা খেয়াল করলে দেখব এখানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব বর্ণনায় পরিবহণ মালিক, যাত্রী ও অর্থনীতিবিদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। যখন জ্বালানি তেলের উর্ধ্বগতি এবং বাংলাদেশের পরিবহণ মালিক ও যাত্রীদের অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়, তখন সেটি ইতিবাচক অর্থনীতি (Positive Eco- nomics) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া বা কর্মকাণ্ড কেমন হওয়া উচিত বা অনুচিত ইত্যাদি বিষয়ে যখন কোনো অর্থনীতিবিদের বক্তব্য বা আলোচনা করা হয়ে থাকে তা নীতিবাচক অর্থনীতির (Normative Economics) আওতাভুক্ত। তাই এখানে অর্থনীতিবিদরা সরকারের যথাযথ নজরদারির বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার জন্য যা বলেছেন, সেটি নীতিবাচক অর্থনীতি।

দলগত কাজ ৩ 

এখন আমরা দলগতভাবে নিজ এলাকার অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর কোনটি ইতিবাচক অর্থনীতি ও কোনটি নীতিবাচক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত তা নির্ণয় করি।

ইতিবাচক অর্থনীতিনীতিবাচক অর্থনীতি

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এখন চলো, আমরা একটি গল্প পড়ি

একজন কৃষকের কয়েক বিঘা জমি আছে। তিনি অর্ধেক জমিতে ধান ও বাকি অর্ধেকে সবজি চাষ করবেন। ধান থেকে যে চাল হয়, তার তিন ভাগের এক ভাগ তিনি নিজের সংসারের জন্য রেখে দিয়ে বাকি অংশ বিক্রি করেন। এভাবেই কয়েক বছর চলে গেল। কোনো এক বছর ধানবীজের দাম বাড়ায় তিনি ধান চাষ কমিয়ে দিয়ে সবজির চাষ করলেন বেশি করে। এর পরের বছর ধানবীজের দাম কমায় তিনি ধান চাষ বাড়িয়ে দিয়ে সবজি চাষ কমালেন। এই বছর তিনি চিন্তা করলেন ধান ও সবজি দুটোই বেশি করে চাষ করবেন। কিন্তু জমির পরিমাণ না বাড়ায় তিনি দ্বিধায় পড়ে গেলেন।

 

অনুশীলনী কাজ ২: আচ্ছা আমরা একটু ভেবে দেখি তো জমির পরিমাণ না বাড়িয়ে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।

 

আমরা হয়তো আমাদের ভাবনাগুলো লিখেছি। আসলে আমরা খেয়াল করলে দেখব, আমাদের উপকরণের যোগান অসীম নয়। ভূমি, শ্রম এবং মূলধনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই কোনো দ্রব্য বেশি উৎপাদন করতে গেলে অন্য দ্রব্য উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। কারণ, আমরা উৎপাদনের উপকরণ একই রেখে সব দ্রব্যের সম্ভাব্য সর্বাধিক উৎপাদন (efficient production) একই সঙ্গে বাড়াতে পারি না। সম্পদের স্বল্পতার কারণে। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সীমিত সম্পদ থেকে আমাদের অসীম অভাব পূরণ করতে হয়। অর্থাৎ যদি কোনো দ্রব্য বা সেবাসামগ্রী উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামালের বা উপকরণের পরিমাণ বা সরবরাহ অসীম হতো, তাহলে আমরা ইচ্ছামতো দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে পারতাম। আমাদের কোনো অতৃপ্তি বা অপূর্ণতা থাকত না। তাহলে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো কিছু বেশি পরিমাণে পেতে হলে অন্য কিছু কম পরিমাণে পেতে হয় বা পাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সম্পদ সীমিত হওয়ার কারণে, কোনো কাজ করা বা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানুষকে সব সময় অন্য কোনো কাজ বা সিদ্ধান্তের সুযোগ ছেড়ে দিতে হয়। কোনো কাজ বা সিদ্ধান্তের সুযোগ ব্যয় (Opportunity cost) হলো সে কাজের জন্য মানুষ যেই কাজ বা কাজের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছে। যেমন: আগের গল্পে আমরা দেখেছি, কৃষক উৎপাদনের সীমিত উপকরণ দিয়ে বেশি ধান উৎপাদন করতে চাইলে তাকে সবজির উৎপাদনের সুযোগ কমিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি ধান উৎপাদনের সুযোগ ব্যয় হলো কমিয়ে দেওয়া সবজির উৎপাদন। আরেকটি উদাহরণ দিয়ে সুযোগ ব্যয়ের ধারণা স্পষ্ট করা যায়। ধরো, তোমার কাছে ২০০ টাকা আছে। তুমি জানো, ২০০ টাকা দিয়ে তুমি একটি বই কিনতে পারবে অথবা বন্ধুরা মিলে কোনো জায়গায় ঘুরতে যেতে পারবে। তুমি যদি ২০০ টাকা দিয়ে বই কেনার সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে ঐ বইয়ের সুযোগ ব্যয় হবে ঘুরতে যাওয়া। আবার তুমি যদি ২০০ টাকা দিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ ব্যয় হবে একটি বই।

মনে করি, কোনো কৃষক তার উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ অর্থাৎ ভূমি (কৃষিজমি), শ্রম এবং মূলধন (যন্ত্রপাতি) ব্যবহার করে দুটি দ্রব্য উৎপাদন করেন- ধান ও পাট। আমরা আগে দেখেছি, সমস্ত উপকরণ ব্যবহার করে একটি দ্রব্য (ধরি ধান) বেশি উৎপাদন করতে চাইলে অন্য দ্রব্য (ধরি পাট) কম উৎপাদন করতে হয়। উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা দেখায়, সমস্ত উৎপাদনের উপকরণ ব্যবহার করে দুটি দ্রব্যের (এই উদাহরণে ধান ও পাট) সম্ভাব্য সর্বাধিক উৎপাদনের পরিমাণের বিভিন্ন সংমিশ্রণ। বোঝার সুবিধার্থে ধরে নিই, ধান ও পাটের উৎপাদনের পরিমাণের ছয়টি সংমিশ্রণ সম্ভব। উৎপাদনের এই ছয়টি সংমিশ্রণ, চিত্রে যে রেখার মাধ্যমে দেখানো হয়, সেই রেখাকে উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা বলে।

টেবিল-উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা ও সুযোগব্যয়

সম্ভাবনাপাট (লক্ষ টন)ধান (লক্ষ টন)

সুযোগব্যয় (লক্ষ টন)

 

A

২৫

 

-
B

২৪

 

C

 

২২

D

১৮

 

E

১০

 

F

 

১০ 

কৃষক যদি শুধু ধান উৎপাদন করেন, তাহলে তো হবে না কারণ, কিছু পাট উৎপাদন করাও প্রয়োজন। তাই ধান উৎপাদনের জন্য যে সমস্ত জমি বা ভূমি রয়েছে, সেখান থেকে কিছু জমি কৃষক পাট উৎপাদনে ব্যবহার করবেন এবং অন্যান্য উপকরণও পাট উৎপাদনের জন্য স্থানান্তর করব। এভাবে কৃষক ধান ও পাটের অনেকগুলো উৎপাদন-সমাহার পেতে পারেন যা উপরের টেবিলে A,B,C,D,E এবং F-এর সাহায্যে সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে।

চিত্র-১ এ ধান ও পাটের উৎপাদন সম্ভাবনা রেখায় সকল উৎপাদন সমাহার দেখানো হয়েছে। এখানে, A, B, C, D, E এবং F উৎপাদনের ছয়টি সংমিশ্রণ উৎপাদন রেখার উপর দেখানো হয়েছে। উৎপাদন-সম্ভাবনা রেখার ঢাল ঋণাত্মক। এই ঢালটি সুযোগ ব্যয় নির্দেশ করে। অর্থাৎ পাটের উৎপাদন বাড়াতে গেলে ধানের উৎপাদন কমাতে হয়। সকল উৎপাদনের উপকরণ বা সম্পদ ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত হলে সর্বোচ্চ ২৫ লক্ষ টন ধান উৎপাদন সম্ভব হয়। চিত্রে এটি A সমন্বয় বিন্দু দ্বারা নির্দেশিত হয়েছে। এখন ধরা যাক, উৎপাদনকারী ১ লক্ষ টন পাট উৎপাদন করতে চায়। যেহেতু A বিন্দুতে সব উপকরণ নিয়োজিত রয়েছে, তাই পাট উৎপাদনের জন্য কমপক্ষে যতটুকু উপকরণের প্রয়োজন তা ধানের উৎপাদন থেকে সরিয়ে আনতে হবে। চিত্রে বাড়তি বা অতিরিক্ত ১ একক (১ লক্ষ টন পাট) পাট উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা A বিন্দু থেকে B বিন্দুতে পৌঁছাই, যেখানে ধানের উৎপাদন ২৪ লক্ষ টন। অর্থাৎ এক একক পাটের উৎপাদনের জন্য এক একক (এক লক্ষ টন) ধানের উৎপাদন কমাতে হয়েছে। B বিন্দু দেখাচ্ছে ২৪ লক্ষ টন ধান এবং ১ লক্ষ টন পাট। অর্থাৎ A থেকে B বিন্দুতে, ১ লক্ষ টন পাটের উৎপাদনের সুযোগ ব্যয় হলো (২৫-২৪=) ১ লক্ষ টন ধানের উৎপাদন। আমরা যতই পাটের উৎপাদন বাড়াব ততই ধানের উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে। চিত্রে B বিন্দু থেকে C বিন্দুতে ২ লক্ষ টন পাট ও ২২ লক্ষ টন ধান উৎপাদন দেখাচ্ছে। অর্থাৎ বাড়তি ১ লক্ষ টন পাটের জন্য ২ লক্ষ টন ধান উৎপাদন কমাতে হবে। এভাবে C থেকে D এবং D বিন্দু থেকে E বিন্দুতে বিভিন্ন উৎপাদন সম্ভাবনা পাব। F বিন্দুতে ৫ লক্ষ টন পাটের জন্য ধানের উৎপাদন শূন্য হবে। এক্ষেত্রে সমস্ত সম্পদ পাট উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হবে। তখন সকল উপকরণের সাহায্যে ৫ লক্ষ টন পাট উৎপাদন সম্ভব। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্রব্য বা পণ্য উৎপাদন করতে চাইলে অন্য দ্রব্যের উৎপাদন সর্বোচ্চ কত হওয়া সম্ভব তা উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার সাহায্যে জানা যায়।

প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং উৎপাদনের উপকরণের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা ডান দিকে স্থানান্তরিত হয়। উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার উপর যেকোনো বিন্দুকে দক্ষ উৎপাদন আর উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার ভেতরে যেকোনো বিন্দু অদক্ষ উৎপাদন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উৎপাদন সম্ভাবনার রেখার বাইরে কোনো বিন্দুতে উৎপাদন সম্ভব নয়; কারণ, সম্পদের স্বল্পতা রয়েছে।

রাষ্ট্রেরও সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে সব উন্নয়ন কাজ একসঙ্গে হাতে নেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প বা কাজকে নির্বাচন করা হয়। যেই প্রকল্প বৃহত্তর জনকল্যাণের সঙ্গে জড়িত সেটিই, আগে বিবেচনা করা হয়। উদ্যোক্তা বা ভোক্তার ক্ষেত্রেও সম্পদের (মূলধন বা আয়) সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুসারে কাজ নির্বাচন করতে হয়।

দলগত কাজ ৩ 

আমরা দলগতভাবে এলাকার অর্থনৈতিক যে যে সমস্যা নির্ধারণ করেছি, তা সমাধানের জন্য কী কী কাজ বা প্রকল্প হাতে নিতে পারি তা আলোচনা করব। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে জন্য অন্য কোনো কাজের সুযোগ ব্যয় হবে কি না, তা নির্ধারণ করি।

আমাদের নির্ধারিত প্রকল্প বা কাজ

অন্য কাজের সুযোগ ব্যয়

 

 

 

 

 

 

 

এই সুযোগ ব্যয় থেকে সিদ্ধান্ত নেব কোন প্রকল্পটি বেশি প্রয়োজনীয়। এভাবে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি প্রকল্প নির্ধারণ করব।

আমাদের তো অনেক কিছুর চাহিদা রয়েছে তাই না? কারো কম বা কারো বেশি। চলো, আমরা এখন আমাদের নিজেদের কী কী জিনিসের চাহিদা রয়েছে তা নিচের ছকে লিখে নিই। এরপর পাশে বসা সহপাঠীর কাছ থেকে জেনে নিই তার কোন জিনিসের চাহিদা রয়েছে। সহপাঠীর চাহিদাগুলোও নিচের ছকে লিখে নিই।

 

অনুশীলনী কাজ ৩: আমার ও আমার সহপাঠীর যে জিনিসের চাহিদা রয়েছে

 

আমার যে জিনিসের চাহিদা রয়েছে

আমার সহপাঠীর যে জিনিসের চাহিদা রয়েছে

 

 

 

 

 

 

 

 

আমরা হয়তো লক্ষ্য করেছি আমাদের নিজের চাহিদা ও সহপাঠীদের চাহিদার মধ্যে কম-বেশি পার্থক্য রয়েছে। তার কারণ হচ্ছে দুজনের পণ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন। তাই চাহিদার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা।

 

অনুশীলনী কাজ ৪: আমাদের যেসব জিনিসের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো বাসা বা স্কুলের কাছাকাছি নিরাপদ দূরত্বে কোনো দোকানে বা বাজারে ক্রয় করা যায়, তার তালিকা করি। সেই দোকানে বা বাজারে গিয়ে আমরা পণ্যগুলোর দাম জেনে নিই।

 

যে পণ্যের আকাঙ্ক্ষা রয়েছেযে দামে আমি কিনতে আগ্রহীবাজারে পণ্যটির দামপণ্যটি কি আমার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে?পণ্যটি কি আমি বাজারের দামে কিনতে চাই?

 

 

 

 

 

 

 

 

    

দোকান বা বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আমরা হয়তো বুঝতে পারছি অনেক পণ্য আছে যেগুলো ক্রয় করার সামর্থ্য আমাদের নেই। আবার অনেক পণ্য আছে যেগুলো কেনার সামর্থ্য বা ক্রয়ক্ষমতা থাকলেও আমরা বাজার দামে অর্থ ব্যয় করতে ইচ্ছুক নই। তাই চাহিদার আরো দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য আমরা পেলাম। সেগুলো হলো ক্রয়ক্ষমতা ও ব্যয়ের ইচ্ছা।

আচ্ছা, আমাদের যে পণ্য বা জিনিসের চাহিদা রয়েছে, এগুলোর দাম যদি কমে যায়, তাহলে কি পণ্যের চাহিদা কমবে না বাড়বে? সাধারণত বেড়ে যাবে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি ক্রয়ক্ষমতাও একইভাবে বেড়ে যায়, তাহলে কী হবে? চাহিদা বাড়বেও না কমবেও না। এরকম কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো অপরিবর্তিত থাকলেই একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যের দাম বাড়লে তার চাহিদা কমে। এই অন্যান্য অপরিবর্তিত বিষয়গুলো জেনে নিই।

১. ভোক্তার আয় 

২. ভোক্তা/ক্রেতার সংখ্যা 

৩. সময় 

৪. আয়ের বণ্টন 

৫. অন্যান্য দ্রব্য ও সেবার দাম

এক কথায়, অন্যান্য নির্ধারক স্থির থাকা অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি দ্রব্যের বা পণ্যের দাম বাড়লে তার চাহিদা কমে এবং দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। একেই চাহিদাবিধি হিসেবে আমরা বিবেচনা করি। অন্যান্য বিষয় যেকোনো একটির পরিবর্তন হলে চাহিদাবিধি অকার্যকর হবে।

চাহিদা সূচি ও চাহিদা রেখা (Demand Schdule & Demand Curve)

একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দ্রব্যের বিভিন্ন দামের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন চাহিদার পরিমাণের সংমিশ্রণ যে সূচির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়, তাকে চাহিদা সূচি বলে। এই চাহিদা সূচি যে রেখার মাধ্যমে বা চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, তাকে চাহিদা রেখা বলে।

টেবিল: গমের চাহিদা সূচি

সমন্বয় বিন্দুপ্রতি কিলোগ্রামের দাম (টাকা)চাহিদার পরিমাণ (হাজার কিলোগ্রাম)

A

 

১০৩০

B

 

১১২৫

C

 

১২১১

D

 

১৩

E

 

১৪

F

 

১৫

চাহিদা সূচির বিভিন্ন দামের পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদার বিভিন্ন পরিমাণের সমাহারগুলো উপরের চিত্র দ্বারা দেখানো হয়েছে। যেখানে কোনো ব্যক্তির জন্য গমের ভিন্ন ভিন্ন দামে চাহিদার ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ A, B, C, D, E এবং F বিন্দু দিয়ে দেখানো হয়েছে।

উপরের চিত্র বা চাহিদা রেখা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, দাম এবং চাহিদার পরিমাণের মধ্যে বিপরীত সম্পর্ক। দাম বাড়লে চাহিদার পরিমাণ কমবে। আবার, দাম কমলে চাহিদার পরিমাণ বাড়বে। তাই চাহিদা রেখার ঢাল ঋণাত্মক। এখানে চাহিদা বিধি কার্যকর বিধায় দাম বাড়লে চাহিদার পরিমাণ হ্রাস পায় এবং তা বিপরীতক্রমেও সত্য। অর্থাৎ চাহিদা রেখা বাম দিক থেকে ডান দিকে নিম্নগামী।

চাহিদা রেখার স্থানান্তর বা পরিবর্তন (Shifting Demand Curve)

চাহিদা বিধিতে আমরা দেখেছি 'অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তি' রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দ্রব্যের দামের হ্রাস বৃদ্ধির ফলে চাহিদার পরিমাণ বাড়ে বা কমে। সেই ভিত্তিতে আমরা উপরের চিত্রে গমের চাহিদা রেখা এঁকেছিলাম। এখন ধরি, অন্যান্য যে বিষয় বা নির্ধারকগুলোকে অপরিবর্তিত ধরা হয়েছিল সেগুলোর পরিবর্তন হয়েছে।

যেমন: ভোক্তার আয় বাড়লে সে আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ ক্রয় করতে পারবে। অথবা বলা যায়, অন্যান্য অপরিবর্তিত নির্ধারকগুলোর যেকোনো একটির পরিবর্তন হলে, চাহিদা রেখা মূল অবস্থান থেকে ডানে বা বামে স্থানান্তর বা পরিবর্তন হয়।

উপরের চিত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোনো ব্যক্তি বা ক্রেতার জন্য মূল গমের চাহিদা রেখা D1। এখন ক্রেতার আয় বৃদ্ধির ফলে যদি অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত থাকে অর্থাৎ গমের দামের কোনো পরিবর্তন হয়নি বা গমের যোগানের কোনো ধরনের পরিবর্তন হয়নি তাহলে পূর্বের নির্ধারিত দামে ভোক্তা আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ গম ক্রয় করতে পারবে। যার ফলে নতুন চাহিদা রেখা D1 থেকে D2-তে স্থানান্তরিত হবে।

যোগান (Supply)

উৎপাদকরা তাঁদের উৎপাদিত জিনিস বা দ্রব্যসামগ্রী বাজারে সরবরাহ করে থাকে মুনাফার আশায়। তাহলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, উৎপাদকারি বা সরবরাহকারীরা কিসের ভিত্তিতে নির্ভর করে বাজারে দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ করে থাকে?

 

অনুশীলনী কাজ ৫: চলো, এখন আমরা বাড়ির কাছের যেকোনো দোকানের পণ্য সম্পর্কে কিছু তথ্য নিয়ে নিচের ছকটি পূরণ করি।

 

দোকানে যে যে পণ্যের সরবরাহ বেশিএই পণ্যের সরবরাহ বেশি হওয়ার কারণ কী?পণ্যের সরবরাহ/যোগান কখন বেড়ে যায় বা কমে যায়?পণ্যের সরবরাহ বাড়া বা কমার কারণ

 

   

 

   

 

   

 

   

আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাব, যদি বাজারে কোনো দ্রব্যের দাম বেশি থাকে বা ভালো পরিমাণে দাম পাওয়া যায়, তাহলে সরবরাহকারী তার উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় বা যোগান বাড়িয়ে বেশি মুনাফা করার চেষ্টা করে। তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে, যে দ্রব্যের দাম কম, সেই দ্রব্যের যোগান বাজারে সীমিত বা অনেক সময়ে বাজারে সেই দ্রব্যের যোগান থাকে না। কারণ, উৎপাদনকারী কোনো দ্রব্য উৎপাদন করতে যে উৎপাদন খরচ হয়, বাজারে যদি ঐ দ্রব্যের দাম তার খরচের তুলনায় কম হয়, তাহলে উৎপাদনকারী ঐ দ্রব্য বাজারে সরবরাহ করবে না বা উৎপাদনই করবে না। তাই দাম এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে হবে যাতে সরবরাহকারী/ উৎপাদনকারী তার উৎপাদন খরচের সমান বা তার বেশি দাম পায়, তাহলে সে উৎপাদন করবে।

তাহলে যোগান বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি পণ্যের বা সেবার বিভিন্ন পরিমাণকে বোঝায় যা সরবরাহকারীরা বাজারমূল্যে বিক্রয় করতে ইচ্ছুক।

যোগান সূচি এবং যোগান রেখা (Supply Schedule & Supply Curve)

আমরা যদি গমের যোগান সূচি বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, বিভিন্ন দামে সরবরাহকারীরা বা উৎপাদনকারীরা যে পরিমাণ সরবরাহ করতে ইচ্ছুক তা যে সূচি বা টেবিলের মাধ্যমে প্রকাশ বা উপস্থাপন করে, তাকেই যোগান সূচি বলে। আর এই যোগান সূচিকে যে রেখার মাধ্যমে অঙ্কন করা হয় তাকে যোগান রেখা বলে।

টেবিল: গমের যোগান সূচি

সমন্বয় বিন্দুপ্রতি কিলোগ্রামের দাম (টাকা)যোগানের পরিমাণ (হাজার কিলোগ্রাম)
A

 

১০
B

 

১৫
C

 

২০
D

 

২৫
E

 

৩০ 

উপরের যোগান রেখাটি যোগান সূচির (বিভিন্ন দামের ভিত্তিতে যে ভিন্ন ভিন্ন সরবরাহের পরিমাণ দেখানো হয়েছে) ভিত্তিতে অঙ্কন করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, দাম বাড়লে বিক্রেতারা সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন, আবার দাম কমলে সরবরাহের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, দাম যখন ৫ টাকা তখন যোগানের পরিমাণ ১০ হাজার কিলোগ্রাম যা চিত্রে A বিন্দু দেখানো হয়েছে। এভাবে দাম বৃদ্ধির ফলে যোগানের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে যা চিত্রে B, C, D এবং E বিন্দুগুলোকে একত্রে যোগ করলে যে রেখাটি পাওয়া যায়, তা-ই যোগান রেখা।

'অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত' বা স্থির থাকা অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি দ্রব্য বা সেবার দাম বাড়লে বিক্রেতারা বা সরবরাহকারীরা বাজার দামে যে পরিমাণ সরবরাহ/যোগান বাড়িয়ে থাকে এবং দাম কমলে যোগান কমিয়ে থাকে, তাকেই যোগান বিধি বলে। দাম ও যোগানের মধ্যে সরাসরি বা ইতিবাচক সম্পর্ক বিরাজ করে। অর্থাৎ দাম বাড়লে যোগানের পরিমাণ বাড়বে এবং দাম কমলে যোগানের পরিমাণ কমবে। যার ফলে যোগান ঊর্ধ্বগামী এবং যোগান রেখার ঢাল ধনাত্মক।

যোগান রেখার স্থানান্তর (Shifting Supply Curve)

অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত' বলতে যে নির্ধারকগুলোকে বোঝানো হয়েছে, তার যেকোনো একটির পরিবর্তনের ফলে যেমন: কাঁচামালের খরচ কমে গেলে উৎপাদক আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে সরবরাহ করতে পারবে। যার ফলে যোগান রেখা ডান দিকে স্থানান্তরিত হবে।

নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ফার্ম অথবা কৃষক গম চাষে আগ্রহী হলে গমের সরবরাহ বেড়ে যাবে। বিক্রেতারা একই দামে বেশি পরিমাণ বিক্রয় করতে পারবে। একেই যোগান রেখার স্থানান্তর বলা হয়। যখন উৎপাদন উপকরণের দাম সহজলভ্য হয়, অথবা উৎপাদনকারী বা বিনিয়োগকারী যে উপকরণ ব্যবহার করে তার দাম কমে যায়, তখন তিনি একই ব্যয়ে বেশি পরিমাণ উৎপাদন করতে পারেন। তখন যোগান রেখা (S1) ডানদিকে স্থানান্তরিত হয়ে (S2) হয়।

নীলিমা একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করল। যেমন: প্রতিটি আইসক্রিমের দাম যখন ১০ টাকা, তখন এর চাহিদার পরিমাণ থাকে ১০,০০০টি কিন্তু যোগানের পরিমাণ হয় ২,০০০টি। যখন প্রতিটি আইসক্রিমের দাম হয় ২০ টাকা, তখন বাজারে চাহিদার পরিমাণ কমে গিয়ে হয় ৮,০০০টি। কিন্তু যোগানের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হয় ৪,০০০টি। এভাবে আইসক্রিমের দাম বাড়লে চাহিদার পরিমাণ কমে এবং যোগানের পরিমাণ বাড়ে। তাই চাহিদা ও যোগানের সমন্বয়ে একটি ভারসাম্য দাম নির্ধারণ করা হয়। যে দামে ভোক্তা বা ক্রেতা পণ্য ক্রয় করার ইচ্ছা পোষণ করে এবং একই দামে বিক্রেতা বা সরবরাহকারী বিক্রি করতে ইচ্ছুক হয়।

 

অনুশীলনী কাজ ৬: আচ্ছা আমরা একটু ভেবে দেখিতো, প্রতিটি আইসক্রিমের দাম কত হলে ক্রেতা আইসক্রিম ক্রয় করার ইচ্ছা পোষণ করবে এবং একই দামে ফ্যাক্টরির মালিক বিক্রি করতে ইচ্ছুক হবে। কেন এই দামে ক্রেতা কিনবে এবং ফ্যাক্টরির মালিক বিক্রি করবে, তার কারণও ব্যাখ্যা করব।

 

আমার ভাবনা

 

 

 

 

চমৎকার, আমাদের অনেকের ভাবনার সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের ভাবনাও মিলে গেছে হয়তো। চলো দেখে নিই চাহিদা ও যোগানের মিথস্ক্রিয়ায় ভারসাম্য দাম কীভাবে নির্ধারণ হয়, তা দেখে নিই।

টেবিল- চাহিদা ও যোগান সূচির মাধ্যমে ভারসাম্য দাম নির্ধারণ

 

আইসক্রিমের দাম (৮)চাহিদার পরিমাণযোগানের পরিমাণউদ্বৃত্ত চাহিদা (Excess Demand: +) উদ্বৃত্ত সরবরাহ (Excess Supply: -)
১০

(+)৮ (উদ্বৃত্ত চাহিদা)

(+)৪ (উদ্বৃত্ত চাহিদা)

০ (চাহিদা ও যোগান সমান: ভারসাম্য)

(-)৪ (উদ্বৃত্ত সরবরাহ)

১০

(-)৮ (উদ্বৃত্ত সরবরাহ)

আমরা টেবিলটিতে চাহিদা ও যোগান সূচি একত্রে উপস্থাপন করেছি। টেবিল দেখা যাচ্ছে, আইসক্রিমের ভিন্ন ভিন্ন বাজার দামে চাহিদা ও যোগানের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন: আইসক্রিমের দাম যখন ১ টাকা, তখন চাহিদার পরিমাণ ১০ ইউনিট এবং যোগানের পরিমাণ ২ ইউনিট। অর্থাৎ এই দামে (১ টাকা অবস্থায়) বাজারে চাহিদার পরিমাণ অনেক বেশি; কিন্তু যোগানের পরিমাণ অনেক কম। তাই বাজারে উদ্বৃত্ত চাহিদা বিরাজ করে। অন্যভাবে বলা যায়, বাজারে আইসক্রিমের দাম ১ টাকা অবস্থায় সরবরাহকারীরা তেমন যোগান দিতে ইচ্ছুক নই। কারণ, হয়তো এই দামে তার উৎপাদন খরচ ওঠে আসে না বা তার সামান্য ক্ষতিও হতে পারে। তাই যোগানের পরিমাণ কম হয় চাহিদার তুলনায়।

টেবিল থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দাম বেড়ে যখন ৩ টাকা হয়, তখন চাহিদার পরিমাণ এবং যোগানের পরিমাণ উভয়েই সমান। অর্থাৎ যে দামে চাহিদা ও যোগানের পরিমাণ সমান হয়, তাকে ভারসাম্য দাম বলে। এই দামে বাজারে অতিরিক্ত চাহিদা বা অতিরিক্ত যোগান থাকবে না। তাই একে বাজার ভারসাম্য বলা হয়।

ভারসাম্য দাম ৩ টাকা ছাড়া অন্য সকল দামে হয়তো চাহিদার পরিমাণ বেশি নয়তো যোগানের পরিমাণ বেশি। তাই চাহিদা ও যোগানের পরস্পরের মিথস্ক্রিয়ায় যে দাম স্থির/নির্ধারণ হয়, তাকে বাজার ভারসাম্য দাম বলা হয়। টেবিলে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে/চাহিদা ও যোগানের সমন্বিত সূচির মাধ্যমে বাজার ভারসাম্য দাম চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল:

চিত্রে,

ES = Excess Supply/উদ্বৃত্ত যোগান 

ED = Excess Demand/উদ্বৃত্ত চাহিদা 

DD = Demand Curve /চাহিদা রেখা 

SS = Supply Curve/যোগান রেখা 

E = Equilibrium Price/ভারসাম্য দাম। যেখানে চাহিদার পরিমাণ এবং যোগানের পরিমাণ সমান সমান।

ভারসাম্য দাম ব্যতীত অন্য কোনো দামে চাহিদা ও যোগানের পরিমাণ সমান হবে না। হয়তো উদ্বৃত্ত চাহিদা বা উদ্বৃত্ত যোগান বিরাজ করবে।

অতিরিক্ত যোগান (Excess Supply) এবং অতিরিক্ত চাহিদা (Excess Demand): মজুদ বা সংরক্ষণ

বাজারে যখন ভোজ্যতেলের মূল্য প্রতি লিটারে ১৬০ টাকা বেড়ে ১৭৫ টাকা হলো, তখন মিজান সাহেব ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দিলেন ৩০ ইউনিট থেকে ৪০ ইউনিট। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় বাজারে চাহিদা কমে যায়। ফলে উৎপাদিত অতিরিক্ত ১০ ইউনিট ভোজ্যতেল তিনি মজুদ বা সংরক্ষণ করে রাখেন।

তাহলে আমরা বলতে পারি, বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহের ফলে তা বিক্রি না হওয়ায় সংরক্ষণ বা মজুদ করতে হয়।

আবার, যেসব কৃষি দ্রব্য পচনশীল এবং সংরক্ষণ করতে না পারলে দ্রুত সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায় ঐ ধরনের দ্রব্যগুলো আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করে রাখতে হয়। ফলে উৎপাদকের খরচের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। উৎপাদন খরচের সঙ্গে সংরক্ষণ বাবদ খরচ একত্র করলে মোট খরচ বেড়ে যায়। ফলে করোনাকালে বেশকিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। আমরা জানি, কোন পণ্যের চাহিদা হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেলে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকলে দামও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় কিছু কিছু উৎপাদনকারী যাদের অধিক উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে, তারা উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে মুনাফা অর্জন করতে পারে। কিন্তু উক্ত সময়ের মধ্যে যদি অন্যান্য উৎপাদনকারীও তাদের উৎপাদন বাড়ায় তাহলে দেখা যাবে বাজারে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। ফলে উৎপাদনকারীরা আবার তাদের দাম কমিয়ে বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়ে থাকে। একটা পর্যায়ে দাম কমতে কমতে ভারসাম্য দামে নির্ধারিত হবে। এক কথায়, ভারসাম্য দাম নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত যোগান এবং চাহিদার তফাৎ বা ফারাক থাকবে,।

বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্য

 

 

 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-এর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশর অবস্থান এর আগেও দ্বিতীয় স্থানে ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে ভিয়েতনাম যখন এই স্থান দখল করে তখন বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে নেমে যায়। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সরকার পোশাকশিল্প মালিকদের অধিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। যার ফলে বেশ কয়েকটি পোশাকশিল্প এখন বিশ্ব বাজারে পোশাক সরবরাহ করতে পারছে। এর মধ্যে (ধরি) ক ও খ গ্রুপ অন্যতম। আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরিকৃত পোশাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

 

করোনাকালে পোশাক শিল্পে বিশ্ববাজার অর্থনীতি কিছুটা স্থবির ছিল। তখন উদ্যোক্তারা চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত অতিরিক্ত পণ্য সংরক্ষণ করেন এবং তাদের উৎপাদন উপকরণের মূল্য হ্রাসে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যেমন: শ্রমিকের সংখ্যা কমানো, বেতন কমানো ইত্যাদি। অনেক মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে বিধায় সরকার এই সমস্যা নিরসনের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পণ্য রপ্তানি এবং স্থানীয় বাজারে পোশাক বিক্রির প্রক্রিয়া সুগম করে দেয়। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, পোশাক শিল্প উদ্যোক্তাদের বিশ্বমানসম্পন্ন পণ্য আরো বেশি পরিমাণে উৎপাদনের প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

ফলে পোশাকশিল্পের মালিকেরা প্রচুর পরিমাণে তৈরিকৃত পোশাক সরবরাহ করছেন। বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ চলার সময়েও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের সরবরাহ বেড়েছে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের দাম কম হওয়ায় ভোক্তাদের কাছে এই পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। একটি রিপোর্ট অনুসারে তুরস্কে তৈরি যে পণ্যটি কিনতে লাগে ৮ ডলার, বাংলাদেশে তৈরি সেই পণ্যটি হয়তো পাওয়া যায় ৩ ডলারে।

তাই বাংলাদেশ যেখানে বিশ্ববাজারে ৪৫ বিলিয়ন ডলার পোশাক যোগান দিয়েছে সেখানে তুরস্ক যোগান দিয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার পোশাক। বাংলাদেশে শ্রমিক মজুরি ও মূলধন যেমন: ভবন, জমি ও টাকা ইত্যাদি কম হওয়ায় কম খরচে পোশাক উৎপাদন করা যায়। এতে পোশাকশিল্পের মালিকেরা কম মূল্যে পোশাক যোগান দিতে পারেন।

বাংলাদেশের অন্যতম আরেকটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য হচ্ছে পাট ও পাটজাত দ্রব্য। যা বিশ্ববাজারে এক বিরাট অংশ দখল করে আছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে এর চাহিদা কমছে। ফলে এই পণ্য উৎপাদনের পরিমাণও কমছে। অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, পাটশিল্পের প্রতি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

পরিবেশবাদীদের মতামত, প্লাস্টিকের তৈরি ব্যাগ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ব্যবহার পরিহার করে পরিবেশবান্ধব পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার করার বিষয়ে ভোক্তাদের আগ্রহী করা যেতে পারে। তবে এতে বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। পাটজাত পণ্য ক্রয়ের চাহিদা বাড়লে যোগান বাড়বে, এতে প্লাস্টিকের পণ্য তৈরির কারখানাগুলোর যোগান কমে যেতে পারে

 

 

 

অনুশীলনী কাজ ৭: এই পাঠে শেখা অর্থনীতির কয়েকটি বিষয় উপরের প্রতিবেদন পড়ে নির্ণয় করি। সেই সঙ্গে বিস্তারিতভাবে লিখি প্রতিবেদনে এই বিষয়ে কী দেওয়া আছে। একটি উত্তর করে দেওয়া আছে।

 

বিষয়প্রতিবেদনে যেভাবে লেখা আছেকারণ/ব্যাখ্যা

ব্যষ্টিক অর্থনীতি 

সামষ্টিক অর্থনীতি

ক গ্রুপ ৫৮ কোটি ডলারের বেশি পোশাক পণ্য উৎপাদন করেছে।

আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরিকৃত পোশাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ফলে পোশাক শিল্পের মালিকেরা প্রচুর পরিমাণে তৈরিকৃত পোশাক সরবরাহ করছেন।

 

প্রতিবেদনে একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদন সম্পর্কে বলা হয়েছে।

ইতিবাচক অর্থনীতি 

নীতিবাচক অর্থনীতি

 

 

 

এখানে সামষ্টিকভাবে বাংলাদেশের সব পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানকে বুঝানো হয়েছে।

সুযোগ ব্যয়

 

  

চাহিদা বিধি

 

  

 

যোগান বিধি

  

 

অতিরিক্ত চাহিদা/অতিরিক্ত যোগান

  

আয় বৈষম্য (Income Discrimination)

আয় বৈষম্য বলতে সমাজ বা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে ব্যক্তি (Individual) বা পরিবারের (Household) মধ্যে আয়ের অসম বণ্টনকে বোঝায়। এটি একটি সামাজিক (Social) এবং অর্থনৈতিক (Economic) সমস্যা যা সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন আয়ের মধ্যে ব্যবধান পরিমাপ করে, যা সম্পদ এবং উপার্জনের বৈষম্যকে নির্দেশ করে।

আমরা এখন আয়বৈষম্যের মূল কারণগুলি উল্লেখ করব

মজুরি বৈষম্য (Wage Disparities): শ্রমিকদের মজুরি (Wage of Labour) এবং কর্মকর্তাদের বেতনের (Salaries of Employees) তুলনামূলক পার্থক্য আয় বৈষম্যের একটি প্রধান অনুঘটক বা উপাদান। বিশেষভাবে অর্জিত জ্ঞান বা উন্নত শিক্ষাসহ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ (Skilled Human Resources) বা কর্মীরা প্রায়ই নিম্ন-দক্ষ (Low Skilled) বা অদক্ষ (Unskilled) শ্রমিকদের তুলনায় উচ্চ মজুরি পেয়ে থাকে। শ্রমিকদের তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা অনুযায়ী মজুরি প্রদান করা হয় না। ফলে উদ্যোক্তা কর্তৃক শ্রমিককে শোষণ করা হয়।

গুণগত শিক্ষা ও দক্ষতার স্তর (Quality Education & Efficiency Level): আয়বৈষম্যের ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উচ্চস্তরের গুণগত শিক্ষা এবং বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ সাধারণত ভালো বেতনের চাকরি এবং উন্মুক্ত কর্মজীবনের সুযোগের দিকে পরিচালিত বা ধাবিত করে। মানসম্পন্ন শিক্ষা, বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা বা পারদর্শিতা এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ চাকরিতে প্রবেশাধিকারের বা সুযোগের বৈষম্য পরবর্তীতে আয়বৈষম্যকে স্থায়ী করতে পারে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি (Technological Advancements): প্রযুক্তিগত অগ্রগতি উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অধিকারী হয়ে আয়বৈষম্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। স্বয়ংক্রিয়তা এবং ডিজিটালাইজেশনের ফলে স্বল্প-দক্ষ কর্মীদের চাকরি স্থানচ্যুতি হতে পারে, আয়ের ব্যবধান আরও প্রসারিত হতে পারে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে যারা খাপ খাওয়াতে পারবে না তারা শ্রম বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অথবা নূন্যতম মজুরিতে চাকরি করতে বাধ্য হবে। যারা যত দ্রুত সম্ভব নতুন প্রযুক্তি বা আধুনিক পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হবে, তারা অধিক আয় করতে পারবে। ফলে নতুন প্রযুক্তিও আয়বৈষম্যের কারণ হতে পারে।

বিশ্বায়ন এবং বাণিজ্য (Globalization & Trade): বিশ্বায়ন বিভিন্ন দেশে চাকরি ও শিল্প স্থানান্তরের মাধ্যমে আয়বৈষম্যকে প্রভাবিত করেছে। যদিও এটি নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে, এটি নির্দিষ্ট সেক্টরে চাকরি হারাতে পারে, নিম্ন-দক্ষ কর্মীদের প্রভাবিত করে এবং আয় বৈষম্যকে বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশের অদক্ষ, স্বল্প দক্ষ এবং দক্ষ শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দক্ষ কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক এবং দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক আমাদের দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, সেবা খাতে, উৎপাদন খাতে এবং অবকাঠামো নির্মাণে নিয়োজিত রয়েছে। এখানে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, আমাদের দেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ লোক বহির্বিশ্বে কর্মরত থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়ে থাকে তার থেকে অনেক কম সংখ্যক বিদেশি বাংলাদেশ থেকে তাঁদের দেশে তুলনামূলক বেশি বেতন-ভাতা পাঠিয়ে থাকেন। কারণ, বিদেশি যারা আমাদের দেশে কর্মরত রয়েছে তাদেরকে উচ্চ বেতনে কাজ দিতে হয়।

কর নীতি (Taxation): কর ব্যবস্থা আয় বৈষম্য কমাতে বা বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রগতিশীল কর কাঠামো, যেখানে উচ্চ উপার্জনকারীদের উচ্চ হারে কর দেওয়া হয়, সম্পদ পুনঃবণ্টন এবং বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিপরীতভাবে, রিগ্রেসিভ ট্যাক্স নীতিগুলো কম আয়ের ব্যক্তিদের উপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বোঝা হয়ে চাপতে পারে।

আয় বৈষম্যের প্রভাব

আয় বৈষম্য সমাজে অর্থনৈতিক সমতা নষ্ট করে। এতে করে ধনী আরও বেশি ধনী হয় আর গরিব আরও বেশি গরিব হয়। নিম্নে আয় বৈষম্য সমাজে আরও যে ধরনের প্রভাব ফেলে তা দেখানো হলো।

সামাজিক সংহতি বিনষ্ট: উচ্চমাত্রার বা চরম আয় বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হতে হতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্রোধ কাজ করে। কারণ, এটি অন্যায় এবং অন্যায়ের অনুভূতি তৈরি করে। ফলে এটি সামাজিক সংহতি বিনষ্ট করতে পারে এবং সমাজকে বিভাজন ও দ্বন্দ্বে ভূমিকা পালন করে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত (Economic Growth): চরম আয় বৈষম্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যদি মুষ্টিমেয় ধনী শ্রেণির মানুষ পেয়ে থাকে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন মানের ইতিবাচক কোনো ধরনের পরিবর্তন না হয়, তাহলে সেই প্রবৃদ্ধি আয় বৈষম্য সৃষ্টি করে। যখন জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত থাকে, তখন এটি ভোক্তাদের চাহিদা কমাতে পারে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে নিম্ন আয়ের ভোক্তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রব্য সামগ্রী বা সেবা বাজার থেকে ক্রয় করতে পারে না।

স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা: আয়বৈষম্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার ফলাফলের সঙ্গে যুক্ত। নিম্ন আয়ের ব্যক্তিরা প্রায়শই উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, গুণগত শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো সীমিত সুযোগ পায়। যার ফলে স্বাস্থ্যের ফলাফল, আয়ুষ্কাল এবং জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দেখা দেয়।

রাজনৈতিক প্রভাব: আয়ের বৈষম্য রাজনৈতিক ক্ষমতার গতিশীলতাকে বিঘ্নিত করতে পারে। কারণ, বেশি সম্পদের অধিকারীরা প্রায়ই নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর বেশি প্রভাব ফেলে। এটি ধনীদের স্বার্থের পক্ষ হয়ে বৈষম্যকে আরও স্থায়ী করতে পারে।

আয় বৈষম্য কমানোর উপায় 

শিক্ষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণ: আয়ের বৈষম্য কমানোর জন্য মানসম্মত শিক্ষা এবং দক্ষতা ও প্রশিক্ষণে প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং উচ্চতর দক্ষতা তাদের কর্মসংস্থান এবং উপার্জনের সম্ভাবনা বাড়ায়।

প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা এবং পুনঃবণ্টন: প্রগতিশীল কর নীতি বাস্তবায়ন সম্পদ পুনঃবন্টন এবং আয় বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে। সরকার উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের জন্য করের হার বাড়াতে পারে এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি ও উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য সম্পদ বরাদ্দ করতে পারে।

ন্যূনতম মজুরি নীতি: ন্যায্য ন্যূনতম মজুরি মান প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ করা নিম্ন আয়ের কর্মীদের উন্নীত করতে এবং আয়ের ব্যবধান কমাতে সাহায্য করতে পারে। মুদ্রাস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের জন্য ন্যূনতম মজুরিতে পর্যায়ক্রমিক সমন্বয় করা উচিত।

সামাজিক নিরাপত্তা জাল: বৃদ্ধ ও অসহায় ভাতা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বেকারত্বের সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা কভারেজ এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের মতো ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা নেট প্রোগ্রামগুলো বিকাশ করা ব্যক্তি এবং পরিবারগুলোর জন্য একটি নিরাপত্তা জাল প্রদান করতে পারে, যারা অর্থনৈতিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়।

সমান সুযোগ নীতি: বৈষম্য বিরোধী ব্যবস্থা, ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির মাধ্যমে সমান সুযোগের প্রচার করা লিঙ্গ, জাতিগত এবং অন্য কারণগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত আয়বৈষম্যকে মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।

শ্রমিকদের অধিকার শক্তিশালী করা: শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা, ন্যায্য শ্রম অনুশীলন নিশ্চিত করা এবং সমষ্টিগত দর-কষাকষি সমর্থন করা আরও ন্যায়সংগত মজুরি এবং কাজের পরিস্থিতিতে অবদান রাখতে পারে।

আয়ের বৈষম্য মোকাবিলার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন, যাতে সরকারি নীতি, ব্যবসায়িক অনুশীলন এবং সামাজিক উদ্যোগগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে, যার লক্ষ্য ন্যায্যতা, সমতা এবং ভাগ করে নেওয়া সমৃদ্ধি।

 

দলগত কাজ 8 

এখন আমরা আগের মতো দলে বসে যাই। আমরা আমাদের এলাকার অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যে একটি প্রকল্প বেছে নিয়েছি, সেটি নিয়ে এখন কাজ করব। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কী কী সম্পদ প্রয়োজন তার একটি তালিকা তৈরি করি। এরপর এই সম্পদ উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ ও সংরক্ষণের উপায় নির্ণয় করি।

আমাদের নির্ধারিত প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এলাকার মানুষ কীভাবে উপকৃত হবে, তা নির্ধারণ করে নিচে লিখি।

 

 

 

 

মুক্ত আলোচনা আমরা দলগতভাবে ইতোমধ্যে এলাকার অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য একটি প্রকল্প নির্ধারণ করেছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করেছি। সেই সঙ্গে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এলাকার মানুষ কীভাবে উপকৃত হবে তা-ও নির্ধারণ করেছি। আমরা আমাদের এই দলগত কাজকে মুক্ত আলোচনা আয়োজন করে উপস্থাপন করব। এজন্য আমরা বিভিন্ন মডেল/পোস্টার/ পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারি। এরপর আমরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখে জমা দেব।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশাম্স বাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল। গণহত্যার পাশাপাশি নারীদের ধর্ষণ, মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন ও দেশের সর্বত্র ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিভিন্ন সেনা ক্যাম্প ও পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন কেন্দ্রগুলো থেকে বহু নারীকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সেসময় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এঁদের অনেকেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি তাঁদের বীরাঙ্গনা (রণাঙ্গনের বীর নারী) আখ্যা দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৭২ সালের ২২শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধকালীন নির্যাতিত নারীদের এই বীরাঙ্গনা খেতাব প্রদান করে। ১৯৭২ সালেই নির্যাতিত নারীদের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার ১৯৭২ সালে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০% পদ মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী অথবা যাদের আত্মীয়-স্বজন শহিদ হয়েছেন এমনসব নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার আদেশ দেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় পুনর্বাসন কেন্দ্র। সমাজে বীরাঙ্গনা নারীরা চরম অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। শেখ হাসিনার সরকার বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা চালু করেন। বর্তমানে গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩৩৯ জন। তাঁদের মহান ত্যাগের জন্য জাতি তাঁদের কাছে চিরঋণী।

Content added By
Promotion